নদ-নদী, ডোবা-পুকুর, খাল-বিল এবং ভূগর্ভের উৎসের পানি দূষিত হলে সেটি উদ্ভিদ, প্রাণী আর মানুষের উপর নানারকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি কখনো কখনো সেগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। পানিদূষণের এই সকল ক্ষতিকর দিকগুলো এবার তাহলে একটুখানি দেখে নেওয়া যাক। তোমরা কি জান, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, সংক্রামক হেপাটাইটিস বি— এসবই পানিবাহিত রোগ? হ্যাঁ, এই সকল জীবন ধ্বংসকারী রোগসহ অনেক রোগ পানির মাধ্যমে ছড়ায়, এমনকি সতর্ক না হলে এই রোগগুলো মহামারী আকারও ধারণ করতে পারে। এসব রোগের জীবাণু নানাভাবে পানিতে প্রবেশ করে, বিশেষ করে মলমূত্র, পচা জিনিস দিয়ে সহজেই এটা ঘটে। সেই পানিতে গোসল করলে, সেই পানি পান করলে, কিংবা সেই পানি দিয়ে খাবার রান্না করলে বা ধোয়াধুয়ি করলে অথবা অন্য যেকোনোভাবে সেই দূষিত পানির সংস্পর্শে এলে সেটি মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর দেহে সংক্রমিত হয়। শুধু তা-ই নয়, কিছু কিছু জৈব পদার্থ আছে, যেমন- গোবর, গাছপালার ধ্বংসাবশেষ, খাদ্যের বর্জ্য সেগুলো পচনের সময় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। তোমরা বল তো এর ফলে জীবনের জন্য পানি কী হতে পারে? বুঝতেই পারছ এর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়। যদি ঐ সকল পদার্থ খুব বেশি থাকে, তাহলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ একেবারে শূন্যে নেমে আসতে পারে। তখন পানিতে বসবাসকারী মাছসহ সকল প্রাণী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে এক সময় ঐ সকল নদ- নদী, খাল-বিল প্রাণীশূন্য হয়ে পড়বে।
আমেরিকার উত্তর ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ইরি (Erle) নামের একটি হ্রদ আছে, যাকে ১৯৬০ সালের দিকে মৃত হ্ৰদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হলো, ঐ হ্রদের চারপাশে বেশ কয়েকটি ডিটারজেন্ট তৈরির কারখানা থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ঐ হ্রদে ফেলার ফলে সেখানে ফসফেটের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। পানিতে ফসফেট আর নাইট্রোজেন খুব বেড়ে গেলে তা প্রচুর শ্যাওলা জন্মাতে সাহায্য করে। এই শ্যাওলাগুলো যখন মরে যায়, তখন পানিতে থাকা দ্রবীভূত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। যার ফলে মাছসহ সকল প্রাণী মরে গিয়ে একপর্যায়ে ইরি “মৃত” একটি হ্রদে পরিণত হয়।এ ঘটনার পর আমেরিকার সরকার আইন করে বিশুদ্ধকরণ ছাড়া শিল্প-কারখানার বর্জ্যপানি হ্রদে ফেলা নিষিদ্ধ করে দেয়।
ডিটারজেন্ট কারখানাগুলো তারপর থেকে বর্জ্যপানি ফসফরাসমুক্ত করার পরে হ্রদে ফেলা শুরু করে এবং আশ্চর্যজনকভাবে, প্রায় দশ বছর পরে ইরি হ্রদে আবার প্রাণীর অস্তিত্ব ধরা পড়তে শুরু করে ।আমাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে এখন কি মাছ পাওয়া যায়? না, পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এর অবস্থা অনেকটাই ইরি হ্রদের মতো। শুধু বুড়িগঙ্গা নদী নয়, আমাদের দেশের অনেক নদ-নদীর পানিই শিল্প-কারখানার সৃষ্ট বর্জ্যপানির কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে, যার কারণে এদের অবস্থা ইরি হ্রদের মতো হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের এখনই সতর্ক না হলে এটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আশার কথা, বুড়িগঙ্গা এবং অন্যান্য নদীর পানি দূষণযুক্ত করার জন্যে নানা ধরনের পরিকল্পনা করে কাজ শুরু হয়েছে।ময়লা-আবর্জনাসহ, শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ মরে গেলে একদিকে যেমন অক্সিজেন স্বল্পতার সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি পানিতে প্রচন্ড দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। এতে করে পানিতে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, নৌকাভ্রমণসহ সব ধরনের বিনোদনমূলক কাজে ব্যাঘাত ঘটে।তোমরা আগেই জেনেছ যে অজৈব পদার্থগুলো (যেমন- এসিড, ক্ষার, লবণ পানিতে বসবাসকারী উদ্ভিদ আর প্রাণীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। পানিতে যদি ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ (যেমন: পারদ, সিসা, আর্সেনিক ইত্যাদি) থাকে, তাহলে ঐ পানি পান করলে মানুষের শরীরে নানা ধরনের রোগ হতে পারে। পারদ, সিসা আর আর্সেনিকের ক্ষতিকর প্রভাব এরকম:
কৃষিজমিতে ব্যবহার করা অজৈব সার (নাইট্রেট ও ফসফেট) দিয়ে পানি দূষিত হলেও মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমন- ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, সিজিয়াম, রেডন প্রভৃতি দ্বারা পানি দুষিত হলে তা একদিকে যেমন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ, অন্যদিকে তেমনি মানুষের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। তেজস্ক্রিয় পদার্থ জীবদেহে নানা প্রকার ক্যান্সার আর শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ সৃষ্টি করে। তোমরা কি বলতে পারবে পানিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কীভাবে আসতে পারে? এর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো (১১ মার্চ, ২০১১ সালে) জাপানের ফুকুশিমা শহরে ঘটে যাওয়া তেজস্ক্রিয় দুর্ঘটনা। ঐ দুর্ঘটনায় সুনামির কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা থেকে প্রচুর তেজস্ক্রিয় পদার্থ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পানি থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যেও প্রচুর তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে।
এছাড়া পানিতে অদ্রবণীয় বস্তু থাকলে পানি ঘোলাটে হয়; এর ফলে কী ধরনের সমস্যা হয় সেটা ভোমরা আগেই জেনেছ।